আফগানিস্তানে বিভিন্ন দিক থেকে গুরুতর সংকট ও অচলাবস্থা চলমান থাকা সত্ত্বেও আর্থিক সূচকগুলোতে তাদের সমৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিকে বাঁচানোর সক্ষমতা তালেবানের নেই, ক্ষমতা গ্রহণের সময় এমন ভবিষ্যদ্বাণী শোনা গেলেও আজ তিন বছর পর বাস্তবতা এমনই বলছে।
বিশ্ব ব্যাংক তার আগস্ট মাসের আফগান অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষণের প্রতিবেদনে বলছে, গেলো বছরই আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক পতন প্রায় শূন্যে নেমে এসেছিলো। বরং সেখানে আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা ও আংশিক সমৃদ্ধির সুস্পষ্ট আলামত লক্ষ্য করা গিয়েছিলো। নতুনভাবে সীমিত পরিসরে ব্যাংকিংব্যবস্থা চালু হয়েছিলো, বিভিন্ন নতুন কোম্পানির যাত্রা শুরু হয়েছিলো, এবং পারিবারিক ক্ষেত্রেও দেশটি স্বল্প উন্নয়ন সম্পন্ন করতে পেরেছিলো। তবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে ব্যাপক লক্ষ্যমাত্রা তা আসলে বেশ অনিশ্চিতই ছিলো। কারণ, দেশটিতে উচ্চমাত্রার দারিদ্র্য হার, খাদ্যের নিরাপত্তাহীনতাও ছিলো ভয়াবহ পর্যায়ে। তাছাড়া প্রতিবেদন অনুযায়ী অর্থনীতিতে নারীর অংশীদারত্বের বিষয়েও তাদের অতি বিধিনিষেধ ছিলো। এতসব সংকটের মধ্যে টেকসই পদক্ষেপ ও ধারাবাহিক সাধনা ছাড়া অর্থনৈতিক মুক্তি আসলে সুদূরপরাহতই মনে হচ্ছিলো।
ওয়াশিংটনের ইউএস ইনস্টিটিউট অফ পিস-এর আফগান বিষয়ক বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম বেয়ার্ড বলেন,
তালেবানরা আফগান অর্থনীতি পরিচালনায় প্রত্যাশার চেয়ে ভালো কাজ করেছে। কিছু ভুল সত্ত্বেও সামগ্রিকভাবে তাদের পরিচালনা প্রত্যাশার চেয়ে ভালে হয়েছে। মুদ্রা বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, যথাযথভাবে রাজস্ব গ্রহণ ও উর্ধ্বমুখী রপ্তানি থেকে বিষয়টি স্পষ্ট।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সূচকসমূহ:
বেয়ার্ড যোগ করেন, ইতোমধ্যেই আফগানিস্তান বেশকিছু যুগান্তকারী পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করছে।
- তাদের কাস্টমসের দুর্নীতি কমেছে।
- চোরাচালান ও ঘুষের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
- যেখানে পূর্বের সরকারের আমলে বাৎসরিক ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি নগদ অর্থ পাচার হয়ে যেত এখন তার বিরুদ্ধে আইনের কঠোর বাস্তবায়ন করে তা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
- বেসরকারি অর্থ স্থানান্তরে কঠোর বিধিমালা গ্রহণ করা হয়েছে।
- কর সংগ্রহের ক্ষেত্রে আপোষহীন পদক্ষেপ গ্রহণ করায় তাদের রাজস্ব সমৃদ্ধ হয়েছে।
- মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আরেকটি বড় নিদর্শন। আফগান ফিউচার ফাউন্ডেশন ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের যৌথ প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তাদের বাৎসরিক মুদ্রাস্ফীতি হার সামগ্রিকভাবে ৯.৭ এ নেমে এসেছে। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশটিতে উল্লেখযোগ্যভাবে জিনিসপত্রের দাম কমেছে। সুনির্দিষ্টভাবে বললে খাদ্যে ১৪.৪% এবং অন্যান্য খাতে ৪.৪% হারে মূল্য হ্রাস পেয়েছে।
মুদ্রাবিনিময় হারে স্থিতিশীলতা:
প্রতিবেদন অনুযায়ী ডলারসহ আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে আফগান মুদ্রার স্থিতিশীলতাকে সে দেশের আর্থিক উন্নয়নের বড় সূচক হিসেবে দেখা হচ্ছে। ২০২১ এর আগস্ট মাস থেকে এক ডলার আফগানীর মূল্য ২২.৮% থেকে এখন ৭০.৩% এ উন্নীত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মুদ্রার নিলামে আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক সুশৃঙ্খল নিয়ন্ত্রণ থাকায় তা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। এতে আমদানিকৃত পণ্যের খরচ কমেছে এবং আমেরিকা কর্তৃক আফগানিস্তানের অর্থকে হিমায়িত করে রাখা ও আন্তর্জাতিক সহায়তা হ্রাস করা সহ আফগান অর্থনীতির উপর বিরাজ করা বিভিন্ন চাপ কমে এসেছে।
এছাড়া প্রতি মাসে আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বেসরকারি মাধ্যমে চল্লিশ মিলিয়ন ডলার সহায়তা আসে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুদ্রা বিনিময় হারে নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে এই সহায়তারও গভীর ভূমিকা রয়েছে।
অভ্যন্তরীণ রাজস্ব:
আফগান সরকার কর সংগ্রহ এবং শুল্ক ও অন্যান্য অভ্যন্তরীণ রাজস্ব শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপ করেছে। বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসের (২০২৪ -র ২২ এ মার্চ থেকে ২১ এ আগস্ট পর্যন্ত) অর্জিত রাজস্বের পরিমাণ ৯০.৬ বিলিয়ন আফগানি বা ১.৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। প্রকাশ থাকে যে, এটি মোট বার্ষিক দেশীয় পণ্যের ছয় ভাগের এক ভাগ। বাৎসরিক লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এই পরিমাণ ১৫% বেশি, এবং পাঁচ মাসের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৩% বেশি হওয়ায় রাজস্ব সংগ্রহে তা একটি মাইলফলকই বটে। সংগৃহীত রাজস্বের মধ্যে কর ছাড়াও উচ্চ পাসপোর্ট ফি, আফগানিস্তানের আকাশসীমায় আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল বৃদ্ধির কারণে ফ্লাইটপ্রতি নির্ধারিত ফি, এবং বিভিন্ন খনি উত্তোলনে প্রদেয় অর্থও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
আমদানি রপ্তানি :
তবে রপ্তানিশিল্পে আফগানিস্তান এ বছর বেশ পিছিয়ে পড়েছে। গোটা আফগানিস্তানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্থিতিশীল থাকলেও এবং সীমান্ত ক্রসিংগুলো বাণিজ্যের লক্ষ্যে উন্মুক্ত থাকলেও চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে দেশটির বাণিজ্যিক অক্ষমতা ৩৮% গিয়ে দাঁড়িয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় ৪.৮ বিলিয়ন ডলার। জানুয়ারি থেকে জুলাই ২০২৪ পর্যন্ত আফগানিস্তানের মোট রপ্তানি ৮০৫ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যা ২০২৩ সালের একই সময়ের তুলনায় ১১% হ্রাস পেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে আফগানিস্তানের অর্থনীতি মনিটরিং করে এমন একটি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাকিস্তানের সাথে আফগানিস্তানের শীতল বাণিজ্যিক সম্পর্কই প্রধান দায়ী। পাকিস্তান সরকার আফগানিস্তান থেকে কয়লা আমদানির উপর নির্ভরতা কমাতে কয়লা চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রকে দেশীয় কয়লায় রূপান্তরিত করেছে। এ ছাড়াও আফগানিস্তান থেকে তাজা ও শুকনা ফল আমদানিতে পাকিস্তান সরকার সব রকম শুল্ক সুবিধা প্রত্যাহার করেছে, সাথেসাথে সীমান্তে কঠোর বিধিমালা আরোপ করেছে। ফলে গত বছর যেখানে প্রথম সাত মাসে পাকিস্তান সরকার আফগানিস্তান থেকে ১৯৮ মিলিয়ন ডলার মূল্যের কয়লা আমদানি করেছে এ বছর একই সময়ে তার পরিমাণ ৫৪ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। শতকরা হিসেবে গত বছরের তুলনায় আফগানিস্তানের এখানে ৭৩% শতাংশ রপ্তানি কমেছে। অন্য দিকে পাকিস্তানে খাদ্য দ্রব্য রপ্তানি ২.৭% কমে গিয়েছে বলেও জানা গিয়েছে।
তবে সম্প্রতি রপ্তানি কমে গেলেও এখনো আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় বাজার পাকিস্তানই। দেশটির মোট রপ্তানির ৪৭% ই হয় পাকিস্তানে। দ্বিতীয় বাজার হিসেবে আছে ভারত। সেখানে মোট রপ্তানি হয় ২৭%। উল্লেখ্য, ২০২৩ -র প্রথম সাত মাসের তুলনায় এ বছর ভারতে আফগানিস্তানের রপ্তানি ৩% বৃদ্ধি পেয়েছে।
সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ:
বিশ্ব ব্যাংকের গবেষকগণ বলছেন, আফগানিস্তানের বর্তমান আর্থিক স্থিতিশীলতা আন্তর্জাতিক সহায়তা ও ভোগভিত্তিক প্রবৃদ্ধির উপর নির্ভরশীল। দেশটিকে টেকসই অর্থনীতিতে পৌঁছতে হলে এসবের উপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজেদের অন্তর্নিহিত শক্তিকে নিপুণভাবে ব্যবহার করতে হবে। মনে করা হচ্ছে, কৃষি ও খনিজ সম্পদ খাতে দেশটির গভীর সম্ভাবনা রয়েছে। অর্থনৈতিক মুক্তিতে এগুলো যেমন বিপ্লবী ভূমিকা রাখতে পারে তেমনি কর্মক্ষেত্রও তৈরি হবে অনেক।
তবে এসব কিছুর জন্যই কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, সেচ অবকাঠামোর ব্যাপকতা, নিরাপদ কৃষিভূমি, যুগান্তকারী গবেষণা, উন্মুক্ত বাজারে পৌঁছতে পারা, সর্বোপরি অসীম অবিচলতা অপরিহার্য।
সূত্র- আলজাযিরা