অনেকটা বাংলাদেশি স্টাইলের বৈপ্লবিক চিত্র দেখা যায় সিরিয়ার দামেস্কে। জনতার বিজয় উল্লাস তারপর ৫ আগস্ট দুপুরের গণভবন দখলের মতো সিরিয়ার মুক্তিকামী জনগণের বাশার আল-আসাদের রাজ প্রাসাদ দখল,অতঃপর বিকালে হাসিনার মতো সিরিয়ার স্বৈরাচারের পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য।
প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে সিরিয়ার মুক্তিকামীদের বিপ্লবী তৎপরতার খবর মিডিয়া মারফত আসছিল। বিশেষ করে হাইয়াত তাহরির আশ-শামের একটি সশস্ত্র গ্রুপ সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হালাবকে কুখ্যাত স্বৈরাচার বাশার আল-আসাদের হাত থেকে দখল মুক্ত করে নেয়, যা ছিল সারা বিশ্বের জন্য বিস্ময়কর এবং সিরিয়ার বিপ্লবীদের জন্য অপ্রত্যাশিত বিজয়। বিপ্লবীদের আক্রমণের সময় হালাবে (আলেপ্পো) দামেস্কের সেনাবাহিনীর আর্টিলারি সেন্টার এবং বেশ কয়েকজন রুশ উপদেষ্টাও ছিলেন।
ইতঃপূর্বেও সিরিয়ার এই গুরুত্বপূর্ণ শহরটি ২০১৬ সালে একবার দখলদারদের হাত থেকে স্বাধীন করা হয়েছিল। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পরে বাশার আল-আসাদের সরকার রাশিয়ার সামরিক সহায়তায় বিদ্রোহীদের কাছ থেকে এটি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
কিন্তু এবার অন্যরকম কিছু হয়। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে মুজাহিদরা খুবই দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয় এবং সে দেশের চতুর্থ বৃহত্তম শহর হামা দখল করে যা দীর্ঘদিন ধরে বাশার আল-আসাদ বিরোধীদের শক্ত ঘাঁটি রূপে পরিচিত। এই শহরে বাশার আল-আসাদের পিতা হাফিজ আল-আসাদের শাসনামলেও সরকার কর্তৃক জনগণের উপর প্রচন্ডরকমের গণহত্যা চলেছিলো।
হত্যাযজ্ঞের চল্লিশ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও হামার জনগণ এই মর্মান্তিক ঘটনার কথা আজও ভুলতে পারেনি। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকগণ সরকার বিরোধীদের হামলায় যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও তুরস্কের মদদ রয়েছে বলে ধারণা করছেন। এটা সহজেই অনুমেয় যে রাশিয়া ও ইরানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল বাশার আল-আসাদ সরকারকে পছন্দ করেনি। বাশার হিজবুল্লাহর সমর্থক ছিল এবং সমর্থনের এই সম্পর্ক ছিল অনেকটা দ্বিমুখী। হিজবুল্লাহর সৈন্যরা “আরব বসন্ত” এর ফলে সৃষ্ট দীর্ঘদিনের নিষ্পেষিত মাজলুম বাশার আল-আসাদ বিরোধীদের খেলাফ লড়াই করেছে এবং এখনও সিরিয়ায় তাদের উপস্থিতি রয়েছে। যদিও ইসরায়েলি হামলা সিরিয়া ও লেবাননে হিজবুল্লাহকে যথেষ্ট দুর্বল করে ফেলেছে।
এখন দেখা যাক তুরস্ক কেন বাশার আল-আসাদের ওপর চাপ তৈরি করেছে। প্রকৃতপক্ষে তুরস্ক চায় সিরিয়া গৃহযুদ্ধের পর তুরস্কের শিবিরে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ শরণার্থীকে ফিরিয়ে দিতে। প্রেসিডেন্ট এরদোগান উত্তর সিরিয়ায় একটি বাফার জোন তৈরি করতে চান যেখানে কোনো সশস্ত্র লোক থাকবেনা। আমাদের পাঠকগণ জেনে থাকবেন যে, তুরস্ক, ইরান এবং ইরাক ছাড়াও উত্তর সিরিয়াতেও কুর্দি জনগোষ্ঠী প্রচুর সংখ্যায় রয়েছে এবং তারা তুরস্কের বিচ্ছিন্নতাবাদী কুর্দিদের সাথে যোগসাজশ রাখে । তুরস্ক মনে করে যে বাশার আল-আসাদ সহসা ক্ষমতা ছাড়ার লোক নয় তাই তুরস্ক সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের ওপর চাপ বাড়ানোর কোনো সুযোগকে হাতছাড়া করতে চাননি।
আসাদ পরিবার ১৯৭০ সাল থেকে সিরিয়া শাসন করে আসছে। ২০০০ সালে রাষ্ট্রপতি হাফিজ আল-আসাদের মৃত্যুর পর ছেলে বাশার আল-আসাদ ক্ষমতায় আসে। আসাদ পরিবার লাতাকিয়ার উপকূলীয় অঞ্চল থেকে এসেছে। তারা আলাভী ফেরকার অনুসারী । ইরান সরকার বাশার আল-আসাদের শক্তিশালী সমর্থক ছিল এবং সিরিয়ার সরকারও ইরানকে সাহায্য করেছিল হিজবুল্লাহর সমর্থন পেতে। সিরিয়ার জনসংখ্যার আশি শতাংশ মানুষ শাফি মাযহাবের সুন্নি। এই সুন্নিদের প্রায় সবাই বাশার আল-আসাদ বিরোধী। হামা শহর সুন্নি সরকার বিরোধীদের প্রধান কেন্দ্র ছিল।
১৯৭০ সালে সামরিক বিপ্লবের মাধ্যমে হাফিজ আল-আসাদ যখন দেশটির রাষ্ট্রপতি হয়,তখন সে সিরিয়ার বিমান বাহিনীর প্রধান ছিল। তার আমলে লোক দেখানো প্রহসনের নির্বাচন হতো এবং প্রধানমন্ত্রী হতো সাধারণত সুন্নিদের ভেতর থেকে। রাজনৈতিক দলগুলো ছিল নামমাত্র। দেশটি বামপন্থী বাথ পার্টি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছিল। এই সিস্টেমে ৫৪ বছর যাবত তীব্র প্রতিবাদ প্রতিরোধ উপেক্ষা করেও ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে সক্ষম হয় তারা।
বাশার সরকার আদতে জনগণ থেকে দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্ন। বাপ বেটা মিলে অর্ধ শতকের বেশি সময় মানুষের উপর জুলুম করেছে। এহেন কোনো অত্যাচার নেই যা সে করেনি এবং পুরো সরকার ব্যবস্থা ছিল তার অনুগত দুর্নীতিগ্রস্ত আর্মি অফিসারদের হাতে। দেশের শাসন ব্যবস্থা এই সমস্ত সেক্যুলার ইসলাম বিদ্বেষী সামরিক সংস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল। সামরিক অফিসাররা বাথ পার্টির সদস্য হয়ে যেতো।
সিরিয়ায় আরব বসন্তের হাওয়া লাগে ২০১১ সালে। তারপর থেকে গৃহযুদ্ধ চলছে, যা গত আট তারিখে বাশার আল-আসাদের পতনের মাধ্যমে শেষ হয়।
হোমসে একটি কৌশলগত সিদ্ধান্তমূলক যুদ্ধ সংঘটিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। বাশার সরকারের শেষ স্ট্রেটেজিক গুরুত্বপূর্ণ শহর হোমস। এটি তুরস্কে যাবার প্রধান সড়কে অবস্থিত। এটি সেই ঐতিহাসিক শহর যেখানে হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদের মাজার রয়েছে। হালব দখলের পরেই সরকার আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলো। পতনের ধ্বনি শুনতে পায় ইরান, তাই তার লোকজন সড়িয়ে নেয় দামেস্ক হাতছাড়া হওয়ার দুইদিন আগেই। তেহরান এবং মস্কো থেকে সাহায্য আসতে পারতো, কিন্তু এই দেশগুলির নিজস্ব জটিল সমস্যা রয়েছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে সর্বস্ব হারা আর ইরানও মধ্যে প্রাচ্যে ক্রমাগত পরাজয়ের সম্মুখীন।
সবশেষে, হোমস শহরটি বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে দামেস্কের উপকূলীয় অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং বাশার আল-আসাদের সরকার তীব্র চাপের মুখে পড়ে। পরিশেষে আট ডিসেম্বর রবিবার ভোরে রাজধানী দামেস্ক সহ পুরো সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে বাশার আল-আসাদ সরকার।
আয়তন ও জনসংখ্যার দিক থেকে সিরিয়া খুব বড় নয়, কিন্তু ভৌগোলিক ভাবে দেশটির অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়ার একমাত্র বিদেশি নৌ ঘাঁটি যা ভূমধ্যসাগরের উপকূলে সিরিয়ার তারতুস বন্দরে অবস্থিত। ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধের কারণে রাশিয়া সিরিয়ার দিকে মনোযোগ দিতে পারেনি, এর ফলেই বাশার আল-আসাদ বিরোধীরা এর পুরো সুযোগ নিতে সক্ষম হন।
তবে বাশার আল-আসাদের পরাজয়ের সাথে সাথে আরব বিশ্বে আরেকটি ইসরাইল বিরোধী সরকারের পতন ঘটেছে। কিন্তু সিরিয়ার পরবর্তী সরকারও ইসরায়েলের মিত্র হবে না বরং আরো কঠোর যায়নাবাদ বিরোধী সরকার হবে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। প্রথমত আগত সরকারের ধরন হবে ইসলামী ও বিপ্লবী। দ্বিতীয়ত, যতক্ষণ ইসরাইল গোলান দখল করে থাকবে, ততক্ষণ সিরিয়ার কোনো সরকার ইসরাইলের প্রতি বন্ধুত্ব মনোভাবাপন্ন হতে পারে না।
আমেরিকা এখন মিশরকে নিয়ন্ত্রণ করে জেনারেল সিসির মাধ্যমে। সাদ্দামকে হটিয়ে ইরাক দখল করে। হিজবুল্লাহর বড় বড় নেতারা একে একে শহীদ হন তারপর এখন আবার সিরিয়া দখলের স্বপ্ন দেখছে। বিপ্লবীদের আমেরিকার প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে যাতে তারা কোনোভাবেই তাদের ডাল পালা সিরিয়াতে গজাতে না পারে। নিজেদের আভ্যন্তরীণ সমস্যা নিজেরাই সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। শিয়া-সুন্নি দাঙ্গা বাঁধানোর সুযোগকেও কাজে লাগাতে চাইবে আমেরিকা ইসরাইল। তাই সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে।
সৌদি আরব থেকেও নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করা উচিত, কারণ তারা যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে বদ্ধ পরিকর। তুরস্ক, কাতার, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ইত্যাদি মুসলিম দেশ সমূহের সাথে সম্পর্ক উন্নোয়নে মনোযোগী হতে হবে এবং ইসলামী আদর্শ দিয়ে সিরিয়ার জনগণের মন জয় করতে হবে। তবেই এই বিপ্লব সফল ও স্বার্থক হবে ইন শা আল্লাহ।

