প্রতিবেদনটি লিখেছেন অর্ণব সান্যাল।
ইসরাইলের ভূখণ্ডে ইরান ৩০০টিরও বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। ইরাক ও ইয়েমেন থেকেও ইরানের স্বপক্ষে ইসরাইলে হামলা হয়েছে। অর্থাৎ, একযোগেই হামলা হয়েছে ইসরাইলে। অবশ্য দেশটির দাবি, এ সব হামলায় ক্ষয়ক্ষতি সামান্যই হয়েছে। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) দাবি, ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের ৯৯ শতাংশই গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে। এই কাজে ইসরাইলকে সহায়তা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, জর্ডান, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ।
সেই দিক থেকে বলতে গেলে, আসলে বড় দু’টি পক্ষের মধ্যে সংঘাত বেঁধেছে। দুই পক্ষই সামরিক ক্ষমতায় বেশ ভারী। এতদিন মধ্যপ্রাচ্য সংকটে ইরান কখনওাই নিজের মাটি থেকে ইসরাইলে সরাসরি আক্রমণ চালায়নি। এবার সেই অভূতপূর্ব ঘটনাটিই ঘটে গেল। অবশ্য এমনটি যে ঘটবে, তা বিগত কয়েকদিন ধরেই বলে আসছিল ইরান। সেক্ষেত্রে বলে, কয়েই হামলা চালিয়েছে ইরান। এটি ইসরাইল ও তার মিত্র দেশগুলোর জন্য বড় একটি ধাক্কা। ইসরাইলের পেছনে স্পষ্টভাবেই দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেনসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় রাষ্ট্র। ফলে সামরিক ক্ষমতার হিসাব কষলে ইরান দাঁড়িপাল্লায় কিছুটা কম ওজনই পাবে। তারপরও ইসরাইলে সরাসরি হামলা চালিয়ে ফেলল ইরান। অবশ্য ২০২০ সালের জানুয়ারিতে জেনারেল কাসেম সোলাইমানি যখন মার্কিন হামলায় নিহত হলেন, তখন থেকেই পালটা হামলা চালানোর কৌশল অবলম্বন করেছে ইরান। সেদিক থেকে ইসরাইলে হামলা চালানোর বিষয়টি পুরোপুরি নতুন কৌশল নয়।
ইরান তবে কীসের জোরে এভাবে পালটা হামলা চালানোর পথে এল? আসুন, জেনে নেওয়া যাক, সামরিক শক্তির দিক থেকে কেন মধ্যপ্রাচ্যে ইরান অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র, সেই বিষয়টির আদ্যোপান্ত।
■ ইরান বনাম ইসরাইল
আন্তর্জাতিক সামরিক শক্তি পর্যবেক্ষণ ওয়েবসাইট গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ারের তথ্য অনুযায়ী, ইসরাইলের চেয়ে সামরিক শক্তিতে কিছুটা এগিয়ে ইরান। ফায়ার পাওয়ার সূচকে ১৪৫টি দেশের মধ্যে ইরানের অবস্থান ১৪তম আর ইসরাইলের অবস্থান ১৭তম।
গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ইনডেক্সের ২০১৯ সালের হিসাব যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখা যাবে বিশ্বে সামরিক অস্ত্রের সক্ষমতার দিক থেকে ইরান এই ১৪ নম্বরে আছে কয়েক বছর ধরেই। বরং ইসরাইলের অবস্থান কিছুটা এগিয়েছে। ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী, ইসরাইল ছিল ১৮ নম্বরে। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা পেয়ে প্রতিনিয়নত নিজেদের সক্ষমতার উন্নয়ন করেছে ইসরাইল।
হালনাগাদ হিসাব অনুযায়ী, নিয়মিত সেনার সংখ্যা, সামরিক উড়োজাহাজ, পরিবহন উড়োজাহাজ, সাঁজোয়া ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া যান, সাবমেরিন ও যুদ্ধজাহাজের সংখ্যায় ইসরাইলের তুলনায় বেশ এগিয়ে ইরান। আবার রিজার্ভ সেনা, যুদ্ধবিমান, হামলায় ব্যবহৃত হেলিকপ্টার ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় এগিয়ে আছে ইসরাইল।
নিয়মিত সেনাতেও ইসরাইলের চেয়ে অনেক এগিয়ে ইরান। ইরানের যেখানে নিয়মিত সেনার সংখ্যা ৬ লক্ষ ১০ হাজার, সেখানে ইসরাইলের ১ লক্ষ ৭০ হাজার।। তবে রিজার্ভ সেনা ইসরাইলের কাছে বেশি।
■ ইরানের মূল শক্তি কীসে
পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ইরানকে সমীহ করা হয় মূলত একটি অস্ত্রের কারণে। সেটি হল ক্ষেপণাস্ত্র। নিজেদের সামর্থ্যেই এমন সব ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে ফেলেছে ইরান, যেগুলোর কারণে ইসরাইলসহ অন্যান্য বিরোধী রাষ্ট্রের ইরানকে ভয় না পাওয়ার কোনও কারণ নেই। যুদ্ধবিমানের সংখ্যা কম থাকায় আকাশপথে শত্রুকে লন্ডভন্ড করা ইরানের পক্ষে কঠিন। ওপরে ইসরাইল ও ইরানের যুদ্ধবিমানের সংখ্যা দেখলেও সেটা বোঝা সহজ। তাই পরিকল্পিতভাবেই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা শক্তিশালী করায় মনোযোগ দেয় ইরান।
দেশটির অন্যতম বিরোধী শক্তি হল যুক্তরাষ্ট্র। সেই মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের দেওয়া তথ্যই বলছে, মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষেপণাস্ত্রের সবচেয়ে বড় মজুত আছে ইরানের। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের পরিচালকের অফিস বলছে, মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যালিস্টিক মিসাইল আছে কেবল ইরানেরই।
খুব নিখুতভাবে লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে না পারলেও এ সব মিসাইল বিক্ষিপ্তভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে সক্ষম। এটা অনেকটা আমেরিকান স্টাইলে ব্রাশফায়ার করার মতো বিষয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ইসরাইল, সউদি আরবসহ পারস্য অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশ ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায় আছে। ফলে শত্রুপক্ষের ক্ষয়ক্ষতি সাধনের ক্ষমতা ইরানের ভালোই আছে। আর এটাই বিরোধীপক্ষের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলতে যথেষ্ট।
■ ইরানের ভাণ্ডারে আছে যেসব ক্ষেপণাস্ত্র
ইরানের আধা সরকারি সংবাদমাধ্যম আইএসএনএ চলতি সপ্তাহে একটি হিসাব দিয়েছে। তাতে দেখানো হয়েছে, ইসরাইলে পৌঁছে আঘাত করার মতো ৯ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র আছে ইরানের। এগুলোর মধ্যে আছে ‘সেজিল’, ‘খেইবার’ ও ‘হাজ কাসেম’। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত কমান্ডার কাসেম সোলাইমানির নামেই শেষ মিসাইলটির নামকরণ করা হয়েছে। এটির সীমা প্রায় ১৪০০ কিলোমিটার। সেজিলের সীমা সবচেয়ে বেশি, আড়াই হাজার কিলোমিটার। খেইবারের সীমা প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার।
গত বছরের জুনে ইরান বিশ্বের সামনে হাজির করেছিল হাইপারসনিক ব্যালাস্টিক মিসাইল। দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম আইআরএনএ তখন বলেছিল, ওটি ইরানের বানানো প্রথম হাইপারসনিক ব্যালাস্টিক খুব নিখুঁতভাবে লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে মিসাইল। এটি শব্দের গতির চেয়ে ৫ গুণ দ্রুত গতিতে উড়তে পারে। এ কারণে ছোড়ার পর এই মিসাইলকে চিহ্নিত করে ভূপাতিত করাও বেশ কঠিন। মার্কিন গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইরানের অস্ত্রভান্ডারে স্বল্প ও মধ্যমপাল্লার নানা ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। এক ডজনের বেশি ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র আছে ইরানের। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (আইআইএসএস) বলছে, ইরানের ৫০টির বেশি মধ্যমপাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল লঞ্চার ও ১০০টির বেশি স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল লঞ্চার রয়েছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা দ্য আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশন বলছে, ইরানের ক্ষুদ্র ও মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের বহরে আছে ‘শাহাব, ১’, ‘জোলফাঘার’, ‘শাহাব, ৩’, ‘ইমাদ, ১’ প্রভৃতি। এর মধ্যে শাহাব ১-এর সীমা ৩০০ কিলোমিটার, জোলফাঘারের সীমা ৭০০ কিলোমিটার, শাহাব-৩-এর সীমা ৮০০ থেকে ১০০০ কিলোমিটার। ইমাদ ১ এখনও তৈরির পর্যায়ে আছে, এর সীমা ২০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এ ছাড়া ‘কিয়াম-১’ নামের ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লা ৭০০ কিলোমিটারের বেশি। ৭৫০ কেজি ওজনের বিস্ফোরক বহন করতে পারে এটি। ইরানের কাছে ক্রুজ মিসাইলও আছে। এর মধ্যে অন্যতম ভয়ানক হল ‘কেএইচ-৫৫’। এটি আকাশ থেকে নিক্ষেপ করা যায় এবং এটি পরমাণু অস্ত্রও বহন করতে সক্ষম। এর সীমা প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার। এ ছাড়া জাহাজবিধ্বংসী উন্নত মিসাইল হিসেবে আছে ‘খালিদ ফারয’। ৩০০ কিলোমিটার পাল্লার এই ক্ষেপণাস্ত্র ১ হাজার কেজির ওয়ারহেড বহন করতে সক্ষম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মূলত উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার নকশায় তৈরি। দেশটির পুরো ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতেই চিনের সহায়তা দৃশ্যমান। একই সঙ্গে প্রতিরক্ষামূলক মিসাইল কর্মসূচিও চালাচ্ছে ইরান। যদিও যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় বিভিন্ন রাষ্ট্র এই কর্মসূচির চরম বিরোধিতা করে আসছে। তবে সেসবে কান দেয়নি ইরান। বরং তাতে অবিচল থাকাতেই মধ্যপ্রাচ্যের ‘মিসাইল, স্টেট’-এ পরিণত হয়েছে দেশটি। এবার বুঝুন, এত ক্ষেপণাস্ত্র থাকা ইরানকে ভয় না পাওয়ার কি কারণ আছে?
■ আরও আছে ড্রোন
ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি ড্রোনেও ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে ইরান। এবং সেটি বেশ দ্রুত গতিতে। রোববারে ইসরাইলে হামলা চালানোর ক্ষেত্রেও ড্রোনের সুচতুর ব্যবহার করেছে ইরান। প্রায় ১০বছর ধরে যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোন ব্যবহার করছে ইরান। দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি মনুষ্যবিহীন এ সব ড্রোন। নিজেরা ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক মিত্রদের কাছেও এই প্রযুক্তি সরবরাহ করছে ইরান। গত বছরের আগস্টে ইরান একটি অত্যন্ত উন্নত ড্রোন বানানোর খবর দিয়েছিল। সেটির নাম ‘মোহাজের-১০’। এর পাল্লা প্রায় ২হাজার কিলোমিটার এবং ৩০০কেজি ওজনের বিস্ফোরক নিয়ে ২৪ঘণ্টা টানা উড়তে সক্ষম মোহাজের -১০।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো অতি উন্নতমানের নয় ইরানের ড্রোন। এক্ষেত্রে নিজেদের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পরে বিকল্প হিসেবে ‘সুইসাইড ড্রোন’ তৈরির দিকেও নজর দিয়েছে ইরান। ‘রাদ ৮৫’ নামের এ সব ড্রোনে বিস্ফোরক যুক্ত করে সেগুলো দিয়ে চালানো যায় আত্মঘাতী হামলা।
■ পরমাণু অস্ত্র কি আছে ইরানের?
ক্ষেপণাস্ত্রের বিশাল বহর আছে ইরানের। এমনকি পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র থাকার খবরও দেশটি দিয়েছে। যদিও এখনও পর্যন্ত ইরানের কাছে পরমাণু অস্ত্র থাকার কোনও প্রমাণ মেলেনি। দেশটি নিজেও এ সংক্রান্ত দাবি কখনও করেনি।
তবে তাই বলে ইরান যে পরমাণু অস্ত্র তৈরির পথে একেবারেই নবিশ, সেটি মনে করার কারণ নেই। পশ্চিমা দেশগুলো প্রতিনিয়তই ইরানের পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টার অভিযোগ করে আসছে। ধারণা করা হয়, ইরানের কাছে পরমাণু অস্ত্র তৈরির গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ ও এ সংক্রান্ত প্রযুক্তিজ্ঞান রয়েছে।
সূত্র- পুবের কলম