এক বছরের বেশি সময় ধরে তন্ন তন্ন করে খুঁজে নৃশংসভাবে তাকে হত্যা করেছে শত্রুপক্ষ। সিনওয়ারকে মারার পর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে ইসরাইল, সঙ্গে সুর মিলিয়ে নেতানিয়াহুকে অভিনন্দন জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
জো বাইডেন বলেছেন,
ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের জন্য আজ একটি শুভদিন। ইয়াহইয়া সিনওয়ার নিহত হওয়ায় গাজার বুকে হামাসের ক্ষমতার অবসান ঘটবে।
পশ্চিমা বিভিন্ন নেতাও একই সুরে কথা বলেছেন। তবে এই হত্যাকাণ্ডের পর কি আসলেই গাজায় হামাসের প্রতিরোধ বন্ধ হয়ে যাবে?
ইতিহাস বলছে ১৯৮৭ সালে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য প্রতিষ্ঠার পর থেকেই হামাসের ওপর এসেছে অভাবনীয় জুলুম। বছরের পর পর বছর ইসরাইলি কারাগারে বন্দী রেখে যোদ্ধাদের ওপর অসহনীয় অত্যাচার করেছে দখলদার বাহিনী। একের পর এক নেতাকে হত্যা করেছে কিন্তু প্রায় চার দশকেও হামাসকে তাদের লক্ষ্য থেকে একবিন্দুও সরাতে পারেনি শত্রুপক্ষ। বরং প্রতিটি আঘাতের পর আগের চেয়ে আরও বেশি শক্তি এবং নয়া কৌশল নিয়ে সামনে এগিয়ে গেছে উপত্যকার সশস্ত্র গোষ্ঠিটি।
সদ্য প্রয়াত হামাস প্রধান ইয়াহইয়া আস সিনওয়ার জন্মগ্রহণ করেছিলেন দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর বাস্তুচ্যুত হয়ে ওই শিবিরে আশ্রয় নেন তার বাবা-মা। ওই শিবিরেই নানা ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে বড় হয়েছেন সিনওয়ার। চোখের সামনে দেখেছেন গাজার নির্যাতিত মানুষের আহাকার। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই ১৯৮২ সালে ইসলামী কার্যকলাপের জন্য তাকে গ্রেফতার করে ইসরাইল, পরে ১৯৮৫ সালে ফের গ্রেফতার হন তিনি। তখন হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনের আস্থা অর্জন করেন এই বীরযোদ্ধা।
ইয়াহইয়া সিনওয়ারের যৌবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে ইসরাইলের জেলে। ২২ বছরের বেশি সময় কারাগারে আটক থাকার থাকার পর ২০১১ সালে বন্দী বিনিময়ের অংশ হিসেবে মুক্তি পান তিনি। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলকে দাঁতভাঙা জবাব দেয়ার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে ধরা হয় ইয়াহইয়া সিনওয়ারকে। তখন থেকেই এই বীর যোদ্ধাকে নিজেদের প্রধান টার্গেটে পরিণত করে ইসরাইলি বাহিনী।
৭ অক্টোবরের অভিযান নিয়েও পক্ষে বিপক্ষে রয়েছে নানা যুক্তি। ধারণা করা হয় একপ্রকার ইয়াহইয়া সিনওয়ারের একক সিদ্ধান্তেই ইসরাইলি সীমান্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে যোদ্ধারা। হামাসের মিত্র ইরান ও হিজবুল্লাহসহ ওই অঞ্চলের মিত্রদের কেউই এই অভিযানের বিষয়ে জানতেন না। গাজার বাইরে থেকে এই অভিযান নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা উঠলেও গাজার ভেতরের পরিস্থিতি বিবেচনায় এই হামলার বিকল্প ছিল না। দিনের পর দিন ইসরাইলি বাহিনীর আগ্রাসনে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল যোদ্ধাদের। নাগরিকদের ওপর অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে তাই সীমান্ত বেড়া ভেঙে আক্রমণ চালায় যোদ্ধারা। জিম্মি করা হয় দুই শতাধিক নাগরিককে। পরে প্রতিশোধ নিয়ে গাজা ধ্বংস করতে পূর্ণ শক্তি ব্যবহার করছে দখলদার বাহিনী।
ইরানের রাজধানী তেহরানে হামলা চালিয়ে গত ৩১ জুলাই হত্যা করা হয় তৎকালীন হামাসপ্রধান ইসমাইল হানিয়াকে। তারপরই যোদ্ধাদের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন ইয়াহইয়া সিনওয়ার। নতুন নেতা আসার পর যোদ্ধাদের প্রতিরোধের কৌশলে বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাস দিয়েছিল সংশ্লিষ্ট কিছু সূত্র। সেই আভাস থেকেই হয়তো ইসরায়েল দ্রুততার সঙ্গে সিনওয়ারকে শেষ করার মিশনে নামে।
হানিয়া বা সিনওয়ার নয়, ইসরাইল আগেও হামাসের একাধিক নেতাকে হত্যা করেছে। ২০০৪ সালে হত্যা করা হয় সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে। এ হত্যাকাণ্ডের কয়েক সপ্তাহ পরই নিহত হন তার উত্তরসূরি আবদেল আজিজ রানতিজি। এভাবে শীর্ষ নেতাদের হারালেও বারবারই ঘুরে দাঁড়িয়েছে হামাস। তবে বর্তমানে মুহূর্তটা বেশ কঠিন, গত এক বছরে গাজাকে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করেছে ইসরাইল। উপত্যকায় সাড়ে ৪২ হাজারের বেশি ফিলস্তিনিকে হত্যা করেছে দখলদার বাহিনী। সেনাদের হামলায় আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। যোদ্ধাদেরও শেষ করতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে নেতানিয়াহুর দেশ।
এখন কীভাবে যোদ্ধারা আবার সংগঠিত হবে, তা নিয়ে বলা কঠিন। এছাড়া সিনওয়ারের শাসনাধীনে হামাসের সাংগঠনিক কাঠামোয় কতটা পরিবর্তন এসেছে, সেটিও পরিষ্কার নয়।
তবে নেতাদের হত্যার মাধ্যমে এই সংগঠনকে শেষ করে দেয়া যাবে এমনটা ভাবার সুযোগ নেই, কেননা এটি একটা আদর্শ। নেতা বা ব্যক্তিকে নির্যাতন বা হত্যার মাধ্যমে কোনো আদর্শকে নির্মূল করা যায় না। সেসব যোদ্ধারা এখন গাজায় লড়াই করছে তাদের স্বপ্ন একটাই, স্বাধীন ফিলিস্তিন। এছাড়া অত্যাচার নির্যাতনের মাধ্যমে ইসরাইলসহ পশ্চিমারা যোদ্ধাদের কাছে এখন ঘৃণার পাত্র। নিজেদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও তারা লড়াই করবে। নিজেদের ঘরবাড়ী, বাবা-মা, আত্মীয় স্বজনসহ এখন তাদের আর হারানোর কিছু নেই।
ইয়াহইয়া সিনওয়ার হত্যার পর হামাস ইতোমধ্যে নিজেদের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছে। যোদ্ধারা বলেছে, সিনওয়ারসহ শীর্ষ নেতাদের এভাবে মেরে ফেলার অর্থ এই নয়, তাদের আন্দোলন–সংগ্রাম শেষ।
শুক্রবার হামাসের এক বিবৃতিতে শোক জানিয়ে বলা হয়েছে,
‘হামাস প্রতিবারই আরও শক্তিশালী এবং জনপ্রিয় হয়েছে। মুক্ত ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার পথে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের যাত্রা অব্যাহত রাখতে এই নেতারা একেকজন আদর্শ হয়ে থাকবেন।’
সিনওয়ার হত্যার পর পশ্চিমারা মনে করেছিল জিম্মি থাকা ইসরাইলিদের মুক্ত হওয়া সহজ হলো। তবে হামাসের ওপর আসা বড় এই আঘাতের পর নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। যোদ্ধারা জানিয়েছে, গাজায় যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে তাদের হাতে আটক থাকা আর কোনো জিম্মিকে মুক্তি দেয়া হবে না। অন্যদিকে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে জিম্মিদের ফেরানোর জন্য নেতানিয়াহুর ওপর চাপ বাড়ছে ফলে যুদ্ধ যে খুব দ্রুত শেষ হচ্ছে, এমন আশা করার কোনো সুযোগ নেই।
লিখেছেন – তৌহিদুর রহমান তুহি