কখনো কি ভেবে দেখেছেন?
আপনি যখন আপনার মা-বাবা, পরিবার-পরিজন, ছেলে মেয়েদের সাথে ঈদে আনন্দ উৎসবের আমেজ উপভোগ করছেন, তখন আপনার মসজিদের ইমাম,মুয়াজ্জিন সাহেব আল্লাহর ঘর মসজিদের মিহরাব-মিম্বার ও মিনারের পবিত্র দায়িত্ব পালন করছেন। মুয়াজ্জিন সাহেব নির্ধারিত সময়ে ৫ বার আজান দিচ্ছেন আর ইমাম সাহেব ৫ ওয়াক্ত নামাজের জামায়াতে ইমামতির গুরুদায়িত্ব আনজাম দিচ্ছেন। খুব কম মসজিদেই কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে স্টাফ ফ্যামিলি কোয়ার্টারের ব্যবস্থা থাকে। ইমাম সাহেবের জন্য কোথাও কোথাও ব্যবস্থা থাকলেও মুয়াজ্জিনদের জন্য একেবারে নেই বললে চলে। ইমামদের জন্যে ফ্যামিলি কোয়ার্টারের সুবিধা আছে এমন মসজিদের সংখ্যাও শতকরা দশের নিচেই থাকবে। শহরে মসজিদের সামান্যতম বেতন পেয়ে নিজ খরচে ফ্লাট ভাড়া করে ফ্যামিলি নিয়ে থাকাটা কি যে কষ্টকর ব্যাপার তা সহজেই বোধগম্য।
অনেকেই সন্তানদের লেখা-পড়া, প্রয়োজন মোতাবেক গ্রামের বাড়িতে যেতে ছুটি না থাকা ইত্যাদি কারণে কষ্টসাধ্য হলেও স্ত্রী-সন্তানকে কাছে রাখেন। কিন্তু মা-বাবা গ্রামেই থেকে যান। দুই ঈদের বিশেষ ছুটি ছাড়া মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনগণ অসুস্থ, বৃদ্ধ মা-বাবার পাশে থেকে খেদমতের সুযোগটাও কম পান। ঈদের দিন যে সব ইমামদের স্ত্রী-সন্তান তাদের সাথে শহরে থাকেন তারা ঈদ একসাথে করতে পারলেও মা-বাবার স্নেহপূর্ণ সান্নিধ্য কিন্তু অনুপস্থিত।
যার ফলে ইমাম মুয়াজ্জিনগণ ঈদের একটি আনন্দঘন মুহুর্তে মা-বাবার সাথে সরাসরি সাক্ষাতে কুশলাদি বিনিময়ে ব্যর্থ হন।
ঈদের পর ছুটিতে ইমাম যদি পরদিন যান তো মুয়াজ্জিন ঈদের এক সপ্তাহ পরে যান কারণ মসজিদ আবাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ রেখে উভয়ে একত্রে যেতে পারেন না। তারা আল্লাহর জন্য যে কোনো একজন স্যাক্রিফাইস করেন।
এবার আসুন ঈদের দিনের কথা বলি । নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি।
এক মসজিদে মহল্লা থেকে পালাক্রমে বাড়ি বাড়ি থেকে দু’বেলা খাবার আসে মসজিদ স্টাফদের জন্য। কিন্তু ঈদের দিন কমিটির উর্ধ্বতন একজন বললেন, ’হুজুর আজকে তো ঈদের দিন, পুরো মহল্লাবাসির পক্ষ থেকে আপনাদের দাওয়াত।’ দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো, কিন্তু ইমাম সাহেবকে কেউ নিতে আসলোনা। ইমাম সাহেব আত্মমর্যাদাশীল ছিলেন। বেচারা হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকায় চা বিস্কুট খেয়ে দিনাতিপাত করলেন।
এই হচ্ছে আমাদের সমাজের বাস্তব চিত্র!
ঈদের দিন কোলাকুলি মোসাফাহাপর্ব সেরে মসজিদ কমিটির লোকজন যার যার ঘরে চলে যান। কেউ একটু দেরিও করেননা এই ভেবে যে যদি ইমাম-মুয়াজ্জিনকে দাওয়াত করতে হয়।
ঈদুল ফিতরে প্রায় মসজিদে ইমাম-মুয়াজ্জিন সাহেবগণ ঈদ বোনাস পেয়ে থাকেন। যদিও দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে ঈদুল আজহায় হাজারে পাঁচজনকেও কোনো ঈদ বোনাস হাফ বা ফুল দেয়া হয় না। অথচ একই দেশে কারখানা শ্রমিকদের দুই ঈদেই বোনাস দেওয়া হয়। না দিলে শ্রমিকদের তীব্র আন্দোলন-অবরোধের প্রেক্ষিতে প্রশাসনকে মালিক পক্ষের প্রতি কঠোরতা করতে দেখা যায়।
এবছর ঈদুল আজহা ইংরেজী মাসের ১ম সপ্তাহে হওয়ায় অনেক মসজিদের ইমামদের মে মাসের বেতনও বিলম্বিত হবে। যা তাদের প্রতি চরম অবহেলার বহিঃপ্রকাশ। যেন মসজিদ সেক্টরে ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেমদের খোঁজখবর রাখার মতো কেউ নেই।
কুরবানির ঈদের দিন ইমাম-মুয়াজ্জিন নামাজান্তে ছুরি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন আপনার জন্তুটি কুরবানি করতে। আপনার জন্তুটি আপনি নিজেই জবাই করবেন, এমনটিই হওয়ার কথা ছিল। মুসল্লিদের আবদার, উপচে পড়া ভালোবাসা, আবেগ দেখে ইমাম সাহেব চলে যান কুরবানি করতে। কার গরুটি আগে কুরবানি হবে সবাই নেমে পড়েন এই প্রতিযোগিতায়। কোথাও কোথাও তো সারা বছর মসজিদ চিনেনা এমন হোমরা চোমরারা জবাইকারীর সঙ্গে বাক-বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন। গত বছর তো এক মসজিদ কমিটির সভাপতি সাহেবের কুরবানি-পশুর জবাই সামান্য বিলম্বিত হওয়ায় দুর্ব্যবহার করে ইমাম সাহেবকে চাকরিচ্যুত করার খবরও পেয়েছি।
আবার কোনো এলাকায় রাজনৈতিক আশীর্বাদপ্রাপ্ত স্থানীয় কিছু মৌলভি থাকেন। তারাও সেদিন ছুরি-চাকু নিয়ে জবাই করতে নেমে পড়ে মুয়াজ্জিন-ইমামের সাথে দ্বন্দে লিপ্ত হন।
ঈদুল আজহার দিন মাগরিব পর্যন্ত খেয়ে না খেয়ে মুসল্লিদের কুরবানি করতে করতে এভাবেই সময় কাটে ইমামদের। তবে অনেক মহল্লায় পশু জবাই করতে গেলে তাদের আপ্যায়ন করা হয় আলহামদুলিল্লাহ।
এবার আসি গোশত হাদিয়ার বিষয়ে।
যে পরিমাণ জন্তু জবাই হয় সেই তুলনায় কুরবানির গোশত ইমামদের হাদিয়া হিসেবে পর্যাপ্ত দেওয়া হয় না। কখনো গোশত নিতে একেক জনের কাছে কয়েকবার গিয়েও খালি হাতে ফেরত আসার দৃশ্যও দেখা যায়।
মা শা আল্লাহ! তবে ব্যতিক্রম দু একজনকে পাওয়া যায় যারা সম্মানের সাথে গোশত মসজিদ স্টাফের কাছে পৌঁছিয়ে দেন। তবে তা সংখ্যায় কম।
আর জবাইয়ের পারিশ্রমিক বার বার চাওয়ার পরেও মাত্র ৫০ টাকা দিয়ে দায়সারা হতেও অনেককে দেখা যায়। অথচ আপনি গরু কিনেছেন ২ লাখ ৩ লাখ টাকা দিয়ে। পারেননি পশুটির জবাইকারীকে ৫০০ টাকা পারিশ্রমিক দিতে !
পরিশেষে, ২টি প্রস্তাবনা রেখে আমার কথা শেষ করতে চাই-
১/ ইমাম/খতীব, মুয়াজ্জিন খাদেমদের জন্য সম্মানজনকভাবে দায়িত্ববোধের সাথে আপনার কুরবানির গোশত হাদিয়া হিসেবে তাদের কাছে আপনি নিজে অথবা কারো মারফত মসজিদে পৌঁছিয়ে দিন।
২/ জবাইকারী ইমাম-মুয়াজ্জিনকে জবাই সম্পন্ন হওয়ার পর বিলম্ব না করে আন্তরিকতার সাথে কমপক্ষে ৫০০ টাকা পারিশ্রমিক দিন।
সেইসাথে ইমামদেরও উচিত মুসল্লিদের কুরবানি করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করার সাথে সাথে নিজেরাও ইমামতির পাশাপাশি ব্যবসা-বানিজ্য করে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হয়ে নিজে কুরবানি করে দরিদ্র মুসল্লিদের মাঝে গোশত বন্টনের নজির স্থাপন করা।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাঁর হক আদায়ের পাশাপাশি বান্দার হকগুলোও আদায়ের তাওফীক দিন। আল্লাহ তাআলা আমাদের কুরবানি কবুল করুন আমীন।
হামিদুল ইসলাম নাফিস
খতীব, ভাংনা বড় মসজিদ, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম কাউন্সিল।