আশুরার দিনের আমল সম্পর্কে কিছু কথা:
সব মাসই আল্লাহর সব দিনও তাঁর। তার মধ্যে কোনো কোনো মাসকে নিজের দিকে নিসবত করে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন তিনি। কোনো কোনো দিন অথবা রাতকেও তিনি বিশেষ ফজিলত দান করেছেন। এই সবকিছুতেই তিনি বান্দার কল্যাণ রেখেছেন। কুরআনে কারিমে বলা হয়েছে যে, আসমান ও জমিনের সৃষ্টিলগ্ন থেকেই আল্লাহর নিকট মাসের সংখ্যা বারোটি।
পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন-
اِنَّ عِدَّةَ الشُّهُوْرِ عِنْدَ اللهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِیْ كِتٰبِ اللهِ یَوْمَ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ مِنْهَاۤ اَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ؕ ذٰلِكَ الدِّیْنُ الْقَیِّمُ. فَلَا تَظْلِمُوْا فِیْهِنَّ اَنْفُسَكُم …
আল্লাহ যেদিন আসমান যমীন সৃষ্টি করেছেন সেদিন থেকেই মাসসমূহের গণনা আল্লাহ তাআলার নিকট তাঁর বিধান মতে বারটি। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। এটাই সহজ-সরল দ্বীন (-এর দাবি) অতএব তোমরা এ দিনগুলোতে নিজের উপর জুলুম করো না।… -সূরা তাওবা (৯) : ৩৬।
সেই বারোটি মাসের মধ্যে চারটি মাসকে সম্মানিত করেছেন। এ চারটি সম্মানিত মাস কী কী? হাদীস শরীফে তা উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- সময়ের হিসাব যথাস্থানে ফিরে এসেছে, আসমান-যমীনের সৃষ্টির সময় যেমন ছিল। (কারণ, জাহেলী যুগে আরবরা নিজ স্বার্থ অনুযায়ী
ও নিজ পছন্দ মোতাবেক মাস-বছরের হিসাব কম-বেশি ও আগপিছ করতো।) বার মাসে এক বছর । এর মধ্য থেকে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি মাস ধারাবাহিক- যিলকদ, যিলহজ্ব ও মুহাররম। আরেকটি হল রজব, যা জুমাদাল আখিরাহ ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৬৬২
মুহাররম মাস এই সম্মানিত চারটি মাসের অন্তর্ভুক্ত একটি মাস হিসেবে যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুহাররম মাসকে আল্লাহর মাস বলেছেন।
আল্লাহর দিকে নিসবত হওয়ার কারণে এই মাস বড়ই ফজিলতপূর্ণ।
বুযুর্গানে দ্বীন বলেন, যারা এই সম্মানিত মাসগুলোতে গোনাহ বর্জন করবে আল্লাহ তাআলা বছরের বাকি মাসগুলোতে তাদের জন্য গোনাহ মুক্ত জীবন যাপন সহজ করে দেন। যারা এই সম্মানিত মাসগুলোতে নেক কাজ করবে আল্লাহ পাক বছরের বাকি মাসগুলোতেও তাদের জন্য
নেক কাজ করাটা সহজ করে দেন।
মুহাররম মাসের রোযা সম্পর্কে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
افضل الصيام بعد رمضان شهر الله المحرم
রমাদানের রোযার পর আল্লাহর মাস মুহাররম মাসের রোযা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়।
তাই এই মাসে বেশি বেশি রোযার ইহতেমাম করা।
দশই মুহাররম বা ইয়াওমে আশুরার ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও গুরুত্ব। এই মুহাররম মাসের দশ তারিখ যাকে আশুরার দিন বলা হয়।
মুহাররম মাসের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ দিন হচ্ছে ‘ইয়াওমে আশুরা’ তথা মুহাররমের দশ তারিখ। হাদীসে আশুরার দিনের অনেক ফযীলত এসেছে।
ঐতিহাসিক ভাবে এই দিনের গুরুত্ব অনেক আগে থেকেই। অন্যান্য নবী রাসুলের যুগেও এই দিনের গুরুত্ব ও মর্যাদা ছিল। বিশেষভাবে হযরত মুসা আলাইহিস সালামের জামানার কথা হাদিস শরিফে পাওয়া যায়। প্রাক-ইসলামী যুগেও আইয়ামে জাহেলিয়াতের সময় আরব সমাজে এবং আহলে কিতাব- ইহুদী-নাসারাদের মাঝেও ছিল এ দিনের বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা।
এমনকি রমাদানের রোযার পূবে এই দিনে রোযা ফরজ ছিল মর্মে বর্ণনা পাওয়া যায়।
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন-
كَانُوا يَصُومُونَ عَاشُورَاءَ قَبْلَ أَنْ يُفْرَضَ رَمَضَانُ، وَكَانَ يَوْمًا تُسْتَرُ فِيهِ الكَعْبَةُ، فَلَمّا فَرَضَ اللهُ رَمَضَانَ، قَالَ رَسُولُ الله صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: مَنْ شَاءَ أَنْ يَصُومَهُ فَلْيَصُمْهُ، وَمَنْ شَاءَ أَنْ يَتْرُكَهُ فَلْيَتْرُكْهُ.
(জাহেলী সমাজে) লোকেরা রমযানের রোযা ফরয হওয়ার পূর্বে আশুরার দিন রোযা রাখত। এ দিন কাবায় গেলাফ পড়ানো হত। এরপর যখন রমযানের রোযা ফরয হল তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে এ দিন রোযা রাখতে চায় সে রাখুক। যে না চায় না রাখুক। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫৯২
এ হাদীস থেকে বুঝা যায় – জাহেলী সমাজে এ দিনের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। এ দিনে তারা কাবা শরীফে গেলাফ আবৃত করতো। এ দিন তারা রোযা রাখত। নবীজিও এ দিন রোযা রাখতেন। হিজরতের পরও এ দিন রোযা রাখতেন। রমযানের রোযা ফরয হওয়ার পূর্বে এ দিনের রোযা ফরয ছিল। রমযানের রোযা ফরয হওয়ার পর এ দিন রোযা রাখা এখন মুস্তাহাব।
এরপর যখন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরত করে মদীনা মুনাওয়ারায় গেলেন তখন সেখানে দেখলেন যে , মদীনার আহলে কিতাব ইহুদীরাও এ দিনে রোযা রাখছে। এ দিনকে তারা বিশেষভাবে উদযাপন করছে।
নবীজি তাদের জিজ্ঞেস করলেন-
مَا هَذَا الْيَوْمُ الّذِي تَصُومُونَهُ؟
এ দিনে তোমরা কী জন্য রোযা রাখছ? তারা বলল-
هَذَا يَوْمٌ عَظِيمٌ، أَنْجَى اللهُ فِيهِ مُوسَى وَقَوْمَهُ، وَغَرّقَ فِرْعَوْنَ وَقَوْمَهُ، فَصَامَهُ مُوسَى شُكْرًا، فَنَحْنُ نَصُومُهُ.
এটি একটি মর্যাদাপূর্ণ দিবস। আল্লাহ তাআলা এ দিনে হযরত মূসা আ. ও তাঁর কওমকে (ফেরাউনের কবল থেকে) মুক্তি দিয়েছেন। এবং ফেরাউনকে তার দলবলসহ (দরিয়ায়) নিমজ্জিত করেছেন। এরপর হযরত মূসা আ. এ দিনে শুকরিয়া আদায় স্বরূপ রোযা রাখতেন। তাই আমরাও রোযা রাখি।
নবীজি তা শুনে বললেন-
فَنَحْنُ أَحَقّ وَأَوْلَى بِمُوسَى مِنْكُمْ.
হযরত মূসা আ.-এর অনুসরণের ক্ষেত্রে তো আমরা তোমাদের চেয়ে বেশি হকদার। এরপর নবীজি নিজেও রোযা রাখলেন এবং অন্যদের রোযা রাখতে বললেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩০; সহীহ বুখারী, হাদীস ১১২৫, ৩৯৪৩
কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়ায় যায় যে ইহুদীদের নিকট এ দিনটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, এ দিনটিকে তারা ঈদের মতো উদযাপন করত। হযরত আবু মূসা রা. থেকে বর্ণিত-
كَانَ يَوْمُ عَاشُورَاءَ يَوْمًا تُعَظِّمُهُ الْيَهُودُ، وَتَتّخِذُهُ عِيدًا، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: صُومُوهُ أَنْتُمْ.
আশুরার দিন এমন একটি দিন, যে দিনকে ইহুদীরা সম্মান করত এবং এ দিনকে ঈদ হিসাবে গ্রহণ করত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা এ দিনে রোযা রাখ। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩১
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা গেলো যে, আশুরার মূল কাজ হচ্ছে সে দিন রোযা রাখা।
আশুরার রোযার ফজিলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন –
صِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ، أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ.
আশুরার দিনের রোযার ব্যাপারে আমি আল্লাহর নিকট প্রত্যাশা রাখি, তিনি পূর্বের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ মাফ করে দেবেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২
রইসুল মুফাসসিরিন হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন-
مَا رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَتَحَرّى صِيَامَ يَوْمٍ فَضّلَهُ عَلَى غَيْرِهِ إِلّا هَذَا اليَوْمَ، يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَهَذَا الشّهْرَ يَعْنِي شَهْرَ رَمَضَانَ.
অর্থাৎ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আশুরার দিনের চেয়ে গুরুত্ব দিয়ে অন্য কোনো দিন রোযা রাখতে দেখিনি এবং রমযান মাস অপেক্ষা অন্য কোনো মাসে এত গুরুত্ব দিয়ে রোযা রাখতে দেখিনি। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২০০৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩২
সাহাবায়ে কেরাম নিজেরা রোযা রাখার পাশাপাশি সন্তানদিগকেও রোযার রাখাতেন।
সাহাবায়ে কেরাম এ দিনে বাচ্চাদেরকেও রোযা রাখতে অভ্যস্ত করতেন। বিখ্যাত নারী সাহাবী হযরত রুবায়্যি‘ বিনতে মুআববিয রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার দিন সকালে আনসারদের এলাকায় লোক মারফত এ খবর পাঠালেন-
যে আজ সকালে খেয়েছে সে যেন সারাদিন আর না খায়। আর যে সকালে খায়নি সে যেন রোযা পূর্ণ করে।
ঐ নারী সাহাবী বলেন, এরপর থেকে আমরা নিজেরাও এ দিনে রোযা রাখতাম এবং আমাদের বাচ্চাদেরও রোযা রাখাতাম। তাদের জন্য আমরা খেলনা বানিয়ে রাখতাম। তারা খাবারের জন্য কান্নাকাটি করলে তাদেরকে খেলনা দিয়ে শান্ত করতাম। ইফতার পর্যন্ত এ নিয়ে তার সময় কেটে যেত। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯৬০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩৬
আশুরার রোযা আমরা কীভাবে রাখবো?
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আশুরার রোযা রেখেছিলেন এবং অন্যদেরকে রোযা রাখতে বলেছিলেন তখন সাহাবীগণ বললেন-
يَا رَسُولَ اللهِ إِنّهُ يَوْمٌ تُعَظِّمُهُ الْيَهُودُ وَالنّصَارَى؟
ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ দিনকে তো ইহুদী-নাসারারা (খ্রিস্টানরা) সম্মান করে? তখন নবীজী বললেন-
فَإِذَا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ إِنْ شَاءَ اللهُ صُمْنَا الْيَوْمَ التّاسِعَ قَالَ: فَلَمْ يَأْتِ الْعَامُ الْمُقْبِلُ، حَتّى تُوُفِّيَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ.
তাহলে আগামী বছর আমরা নয় তারিখেও রোযা রাখব- ইনশাআল্লাহ। কিন্তু সেই আগামী বছর আসার পূর্বেই নবীজির ইন্তেকাল হয়ে যায়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩৪
এজন্য আমরা নয়-দশ তারিখ রোযা রাখবো অথবা দশ-এগারো তারিখ মিলিয়ে রোযা রাখবো।
এক্ষেত্রে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ এর কথাটি বেশ লক্ষ্যণীয় তিনি বলতেন-
صُومُوا التّاسِعَ وَالعَاشِرَ وَخَالِفُوا اليَهُودَ.
তোমরা নয় তারিখ এবং দশ তারিখ রোযা রাখ এবং ইহুদীদের বিরোধিতা কর। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৫৫।
অতএব শুধু আশুরার দিন একটি রোযা রেখে যেমন ইয়াহুদিদের সাথে সাদৃশ্যতা করবনা, তেমনি জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বিজাতীয় ইয়াহুদি-পশ্চীমা সংস্কৃতি আমদের পরিহার করে চলতে হবে।
আশুরার দিনে তাওবার গুরুত্ব। মুমিনের জীবনে তাওবার গুরুত্ব অপরিসীম। মুমিন সব সময়ই নিজের কৃত কর্মের জন্য আল্লাহর কাছে তাইব হবে এটিই স্বাভাবিক। তন্মধ্যে আল্লাহ তাআলা বিশেষ কিছু মুহূর্ত এমন রেখেছেন যখন তিনি তার রহমতের মুষলধার বারিধারা বান্দার প্রতি নাজিল করেন।
বান্দার গোনাহ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়। সেই বিশেষ মুহূর্তের রাত দিনের ইহতেমাম করা উচিৎ।
তাওবাহ কবুলের বিশেষ একটি দিন হলো আশুরার দিন।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
فِيهِ يَوْمٌ تَابَ فِيهِ عَلَى قَوْمٍ، وَيَتُوبُ فِيهِ عَلَى قَوْم آخَرِينَ.
মুহাররম মাসে এমন একটি দিন আছে, যেদিন আল্লাহ তাআলা (অতীতে) অনেকের তাওবা কবুল করেছেন। ভবিষ্যতেও অনেকের তাওবা কবুল করবেন। মুহাদ্দিসিনে কেরাম সেই দিনটিকে আশুরার দিন হওয়ার সম্ভাবনা ব্যক্ত করেছেন।